একবুক ‘কষ্ট’ নিয়ে রাজধানী ছাড়ছেন স্মার্ট ঝালমুড়ি ওয়ালা
‘বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, জুলহাস কেন পিছিয়ে থাকবে? প্রথমে লু’ঙ্গি পড়ে ঝাল মুড়ি ‘'বিক্রি করতাম। এখন পরিষ্কার ও স্মা’র্ট কাপড় পড়ে ঝাল মুড়ি ‘'বিক্রি করি। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে সি’ঙ্গাপুরের মতো আধুনিক বানাতে চায়। আমা’র কাছেও যারা ঝালমুড়ি খায়, তারা মনে করে সি’ঙ্গাপুর বসে খাচ্ছে।’





কেউ পরিচয় জানতে চাইলে এভাবেই নিজের ব্যাখ্যা দেন স্মা’র্ট ঝালমুড়ি ওয়ালা খ্যাত বহুল আলোচিত ব্যক্তি জুলহাস হাওলাদার। এই স্মা’র্ট ঝালমুড়ি ওয়ালাকে এবার চিরতরে হারাতে যাচ্ছে রাজধানীবাসী। ছেলের চিকিৎসা ও সংসারের হাল টানতে না পেরে এবার রাজধানীতে আর না থাকার সি’'দ্ধান্ত নিয়েছে জুলহাস।
রাজধানীর শাহবাগের ব’ঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ফুটপাতে ঝালমুড়ি ‘'বিক্রি করেন জুলহাস। তার মুড়ি রাখার বস্তায় একপাশে রাখেন ফুলের মালা দিয়ে সাজানো ব’ঙ্গবন্ধুর বাঁধাই করা একখানা ছবি আর অন্য পাশে রাখেন তার বাবার মুক্তিযো’'দ্ধার সনদের বাঁধাই করা ফটোকপি। চোখে চশমা, কানে এয়ারফোন, চকচকে শার্ট, গলায় টাই, পায়ে কালো সু, পকে’টে মোবাইল ও কলম এবং হাতে সিলভার রংয়ের ঘড়ি পরেন জুলহাস। ৪৫ বছর বয়সের এই ব্যক্তি সর্বদা এমন পরিপাটি সাজে ঝালমুড়ি ‘'বিক্রি করে রীতিমত ভাইরাল।





১৯৭৫ সালের ১মে শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজে’লার ধানকাটি গ্রামে জন্ম জুলহাসের। বর্তমানে তিন সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে বসুন্ধ’রা সিটি শপিং মলের পেছনে ছোট একটি বাসায় ভাড়া থাকেন তিনি। তার পিতা মো. তছলিম হাওলাদার একজন মুক্তযো’'দ্ধা ছিলেন। যু’'দ্ধে বাংলাদেশ জয়ের পর এদেশীয় রাজাকারদের হাতে তার পিতার মৃ'’ত্যু হয়েছে বলে দাবি জুলহাসের।
জুলহাস জানান, ‘বাবা যখন মুক্তিযু’'দ্ধে অংশ নিতে যায় তখন দাদাকে এদেশীয় রাজাকাররা কুকুরের ভ্যাকসিন দিয়ে মে’রে ফেলে। পরবর্তীতে দেশ জয়ের পর বাবা যখন ফিরে আসে তখন অন্যান্য মুক্তিযো’'দ্ধাদের স’ঙ্গ নিয়ে ওইসব রাজাকারদের মে’রে ফেলা হয়। সেই রাজাকাদের বংশের লোকরাই পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফখরুদ্দিন আহমেদের সময়ে আমা’র বাবা ও বড় ভাইকে হ’'ত্যা করে।’





তিনি জানান, ‘আমা’র বাবা ব’ঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে যু’'দ্ধে যাওয়ার সময় ঘরে দু’মুঠো চাল ও ডাল পর্যন্ত রেখে যেতে পারেননি। যু’'দ্ধের চার বছর পর আমা’র জন্ম হয়েছে। মানুষের বাসা থেকে ভাতের মাড়, জুটা খাবার কুড়িয়ে খেয়েছি। অভাবের কারণে লেখাপড়া করতে পারিনি। বাসা বাড়িতে কাজ করেছি, বিভিন্ন পেশার পর এখন স্মা’র্ট হয়ে ঝালমুড়ি ‘'বিক্রি করছি।’
পূর্বে গণমাধ্যমের নিউজ ও বিভিন্ন ইউটিউবারদের ভিডিওতে জুলহাস প্রধানমন্ত্রীকে নিজ হাতে ঝালমুড়ি বানিয়ে খাওয়ানোর সখের কথা জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীকে ঝালমুড়ি বানিয়ে খাওয়ানোর সখ পূরণ হয়েছে কিনা জানতে চাইলে জুলহাস বলেন, ‘না, এখনও আমি প্রধানমন্ত্রীকে নিজ হাতে ঝালমুড়ি বানিয়ে খাওয়াতে পরিনি। প্রধানমন্ত্রীর স’ঙ্গে কাছ থেকে দুটো কথা বলতে পারলে আর তাকে আমা’র হাতে ঝালমুড়ি বানিয়ে খাওয়াতে পারলে আমি সবথেকে বেশি শান্তি পাবো। আমা’র বিশ্বা’স একদিন আমি এ সখ নিশ্চয়ই পূরণ করতে পারবো। জননেত্রী ভিক্ষুকদের স’ঙ্গে কথা বলেছেন, ভ্যানচালকের স’ঙ্গে কথা বলেছেন, আমা’র স’ঙ্গেও তিনি কথা বলবেন।’





বিশ্ব এখন করো’’না ভাইরাসের প্রভাবে কলঙ্কিত। বাংলাদেশও এই পরিস্থিতির বাহিরে নয়। আগে পরিপাটি পোশাকে স্মা’র্ট এ ঝালমুড়ি ‘'বিক্রেতা জুলহাসকে ঘিরেই উৎসুক মানুষের ভিড় লেগে থাকতো। করো’’নার কারণে এখন সেই ভিড় নেই। এ সময়ে ব্যবসা কেমন যাচ্ছে জানতে চাইলে জুলহাস বলেন, ‘করো’’নায় ঝালমুড়ি আগের মতো এখন আর মানুষ খায় না। তাই বেচা-‘'বিক্রি কম হওয়ায় রাজধনীতে টিকে থাকা’টা এখন আমা’র জন্য ক’'ষ্টকর হয়ে পড়েছে। তাছাড়া, আমা’র তিন সন্তানের মধ্যে বড় ছেলেটার একটা কঠিন রোগ হয়েছে। যার চিকিৎসা এদেশে নেই। ওকে একটু ভালো খাবার খাওয়াবো তাও প্রতিদিন ব্যবস্থা করতে পারি না। আমি সি’'দ্ধান্ত নিয়েছি আগামি দু’এক মাসের মধ্যে রাজধানী ছেড়ে চিরতরে গ্রামে চলে যাব'’ো।’
গ্রামে গিয়ে স্মা’র্টভাবে ঝালমুড়ি ‘'বিক্রি করবেন কী, সেখানে কী রাজধানীর থেকে বেশি আয় করতে পারবেন জানতে চাইলে জুলহাস বলেন, ‘এতদিন গ্রামে ঘর ছিলো না। মা কিস্তিতে টাকা এনে আমা’র জন্য একটি ঘর তুলেছেন। আমি আমা’র পরিবার নিয়ে সেই ঘরে গিয়ে থাকবো। ঢাকায় বাসা ভাড়া দিতে হয়, শাক-সবজি থেকে শুরু করে সব কিছু কিনতে হয়। কিন্তু গ্রামে থাকলে আমি শাক-সবজী চাষ করতে পারবো। মাছ ধরতে পারবো। আর যে কাজ পাবো সেই কাজ করবো। সুযোগ হলে গ্রামে গিয়ে ঝালমুড়ি ‘'বিক্রি করবো।’





সরকার গৃহহীনদের ঘর দিচ্ছে, পুঁজিহীনদের ব্যবসা করতে ঋণ দিচ্ছে এসবের কিছু পেতে আগ্রহী কীনা জানতে চাইলে জুলহাস জানান, ‘আমি সরকারের কাছ থেকে দানের কিছু চাই না। আমি ভালোভাবে ব্যবসা করতে চাই। কিন্তু ব্যবসা করার পুঁজি আমা’র নেই। সরকার যদি আমাকে ব্যবসা করার জন্য সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করে দেয় তবে আমি ৫০টি ছাগল ও ১০০টি মুরগী পালবো। টাকা পেলে আমি এই ধরনের ব্যবসা করতে চাই। আমি সরকারের থেকে দান চাই না, ঋণ চাই।’
সুমা বেগম আরও বলেন, ‘আমা’র স্বামী ব’ঙ্গবন্ধুর আদর্শকে শ্র’'দ্ধা করে বুকে ধারন করেছে। এজন্য আমিও আমা’র স্বামীকে সব সময় সম্মান করি। ব’ঙ্গকন্যা শেখ হাসিনার কাছে আমা’র ছেলেটার সু-চিকিৎসার দাবি জানাচ্ছি। আমা’র সন্তানটি সুস্থ্য হলে এটাই হবে আমা’র সবথেকে বড় পাওয়া।’




