৩৫ বছর পর বাবার দেনা শোধ করে ছেলে বললেন ‘পৃথিবীর সেরা কাজটি করলাম’
১৯৮৮ সালে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার চরপাথরঘাটার বাসিন্দা ফজলুল হক স্থানীয় নয়াহাটের জুয়েলার্স মালিক মোহন লাল ধর এর কাছে জমির দলিল বন্ধক রেখে ধার নিয়েছিলেন ৫ হাজার টাকা। সেকালে সেই টাকাই ছিলো অনেক।
তবে সেসময় ঠিকাদারিতে লোকসান হওয়ায় দেওয়া হয়নি সেই টাকা। দিনের পর দিন বাড়তে থাকে সুদ। ১৯৯৬ সালে জমি বিক্রি করে দশ হাজার টাকা ফেরত দিতে গিয়েছিলেন তিনি।
উদ্দেশ্যে ছিলো সকল ধার শোধ করে দায়মুক্ত হওয়া। কিন্তু সুদ-আসলে টাকার পরিমাণ আরও বেশি হওয়ায় তাঁকে ফিরে আসতে হয়েছিলো। পরবর্তীতে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে দুই বছর পর মারা যান ফজলুল হক।
মৃত্যুর আগে জুয়েলার্স মালিকের কাছ থেকে নেওয়া ৫ হাজার টাকার দেনা পরিশোধ করতে বলে যান কিশোর ছেলেকে। আর সেই থেকে প্রয়াত বাবার সেই দেনা পরিশোধ করতে ছেলে পাওনাদারকে খুঁজেছেন গত ২৭ বছর ধরে। ঠিকানা বদল হওয়ায় মিলছিল না খোঁজ। এরই মধ্যে মারা গেছেন সেই মোহন লাল।
তবে অবশেষে আনোয়ারার বটতলী ইউনিয়নের রুস্তমহাট এলাকায় পাওয়া যায় প্রয়াত মোহন লাল ধর এর নাতি সুজন ধর-কে। নিউ ওমান জুয়েলার্সে তাঁর হাতে নগদ টাকা তুলে দিয়ে বাবার দেনা থেকে দায়মুক্ত হলেন ছেলে মো. সেলিম হক।
কর্ণফুলী উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক সেলিম হক জানান, ‘বাবা মারা যাওয়ার আগে বলে গেছেন যেন তাঁর দেনা আমি পরিশোধ করি। তিনি মারা যাওয়ার পর মা আর বোনকে নিয়ে কষ্টে পড়ি। সংসারের হাল ধরতে হয়েছিলো। এসএসসি পরীক্ষার পর টিউশনি আর চাকরি করে লেখাপড়ার খরচসহ সংসার চালিয়েছি। এরপর শুরু করলাম ব্যবসা। ২০১২ সালে মাকে নিয়ে হজে যাই। বাবার পাওনাদারকে খুঁজে না পেয়ে এলাকার মাওলানার পরামর্শে এক ব্যক্তিকে হজে পাঠাই এবং গরীবদের কিছু টাকা দান করেছি। তবুও মনে হতো, যার টাকা তাকে দিতে পারলে ভালো লাগতো’।
‘মা জানালেন, সেই পাওনাদারের বাড়ি আনোয়ারার শাহ্ মোহছেন আউলিয়া মাজার এলাকায় হতে পারে। এরপর আনোয়ারায় বিভিন্নজনের সহায়তায় চলে অনুসন্ধান। অবশেষে বটতলী এলাকায় গিয়ে সন্ধান মিলে মোহন লাল ধর এর ওয়ারিশদের সঙ্গে। আমাদের এলাকায় তাঁকে ‘মনু কর্মকার’ নামে সবাই চিনতো। তাঁরই নাতি সুজন ধর এর হাতে বৃহস্পতিবার (২৩ মার্চ) বিকালে স্থানীয় আওয়ামী নেতা মো. মোক্তার জামানের মাধ্যমে তুলে দেওয়া হয় নগদ ২০ হাজার টাকা’।
তিনি আরো জানান, ৩৫ বছর পর বাবার দেনা শোধ করতে পেরে মনে হচ্ছে, পৃথিবীর সেরা কাজটি করলাম। বুকটা হালকা হলো। নিজেকে পৃথিবীর সেরা সুখী ভাবছি’-বলেন সেলিম হক।দাদার পাওনা টাকা ফেরত পেয়ে নাতি সুজন ধর বলেন, ‘প্রায় ৫০ বছর ধরে এখানে দোকান করছি। দাদার সঙ্গেও দোকানে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। তবে দাদা কখনও বলেননি যে, কর্ণফুলী এলাকার কারও কাছ থেকে তিনি টাকা পাবেন। দাদা মারা গেছেন কয়েক বছর আগেই।
সুজন আরো জানান, এক বছর আগে সেলিম হক আমাদের খোঁজ পেয়েছেন। এরপর থেকে তিনি টাকা ফেরত নেওয়ার জন্য প্রস্তাব দিয়ে আসছেন। প্রথমে রাজি না হলেও পরে মেনে নিয়েছি। বর্তমান সময়ে অনেক কিছু বন্ধক দিয়েও মানুষ ফেরত নেন না, টাকা ধার নিয়েও দেন না। অথচ তিনি বাবার নেওয়া টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য অস্থির ছিলেন। প্রয়াত ফজলুল হকের আত্মার শান্তি কামনা করছি’। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা মো. মোক্তার জামান বলেন, সেলিম হক দীর্ঘদিন ধরে তাদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য। স্থানীয়দের সহযোগিতায় প্রয়াত মোহন লাল ধর এর ওয়ারিশদের সঙ্গে কথা বলে টাকাগুলো ফেরত দেওয়া হয়েছে।